সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি গ্রামে তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের ইতালীয়ান টালি/টাইলস। বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে এই টাইলস বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ আনছে ডলার, পাউন্ড। সম্প্রতী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যে সাতক্ষীরার মাটির গুন ও মাটির টাইলস নিয়ে বক্তব্য দেশব্যাপি আলোচনার ঝড় তুলেছে। সেই আলোচনার জোয়ার উপকূলীয় জেলায় খুব ভালো ভাবেই লেগেছে। জেলা জুড়ে তাই এখন মানুষের নজর এখন কলারোয়ার মাটির টাইলস এর দিকে।
সারাবিশ্বে করোনাকালীন সময়ে যখন বৈশ্বিক মন্দা তখন ও কলারোয়ার মাটির তৈরি টাইলস বিদেশে রপ্তানি করে দেশের জন্য ডলার, পাউন্ড নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। সাড়া জাগানো এই খাতের সম্ভবনা রয়েছে প্রচুর, সাথে আছে নানা প্রতিবন্ধকতা।
মুরারীকাটি গ্রামের মৃৎশিল্পিরা তাদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় বিশ্বমানের এই টাইলস তৈরি করছে। আধুনিকতার এই যুগে এখন ও কোন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি এই পালপাড়ায়। পূর্বের নিয়মে মাটি সংগ্রহ করার পর বছরের পর বছর উঁচু স্তুপ করে রাখতে হয়। তারপর সেখান থেকে মাটি কেটে কুমোররা পায়ের মাধ্যমে কাঁদা তৈরি করে মন্ডা/খামির। মাটি তৈরির পর শিল্পি তার নিপুন হাতের ছোঁয়ায় ও সাঁচে ফেলে তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের টাইলস। সেগুলো রোদে শুকিয়ে তারপর রং ধরানো হয় প্রত্যেকটি টাইলসে। রং লাগানোর কাজ শেষ হলে রোদে শুকিয়ে পোনে সাজানো হয় (বিশেষ পদ্ধতিতে আগুনে পোড়ানোর জন্য) সাজানো হয় এই টাইলস।
২০০২ সালের পরবর্তী সময়ে এই টালি/টাইলস কলারোয়ার পাল পাড়ায় যাত্রা শুরু করে তৎকালিন সময়ে ৪১ টি কারখানা নিয়েবযাত্রা শুরু করে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতা পার করে এখন টিকে আছে মাত্র ১৩ টি কারখানা। সেখান থেকে উৎপাদিত টালি বছরে ১০ থেকে ১২ কোটির মতো টালি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। দেশে আসে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার মতো বৈদেশিক মূদ্রা।
প্রতি পিস টালির দাম ৫টাকা থেকে ৭৫ টাকা পর্যন্ত। স্কয়ার টালি সাধারণত দেয়ালের শোভা বর্ধনে ঘরের চালের ছাউনিতে ব্যবহার করে থাকে বিদেশীরা। ঘরের মেঝে সাজানোর জন্য রয়েছে ফুলের আকারে প্রভেন সালেহ। প্রতি পিস প্রভেন সালেহর দাম ২৫ টাকা। এভাবে একেকটি টালির নকশা, গঠন ও আকার অনুযায়ি দামের হেরফের রয়েছে। ঘর সাজানোর জন্য সার্কেল টাইলস। ৪টি সার্কেল টাইলস নিয়ে একটি সেট। এক সেট সার্কেল টাইলস’র দাম ৪০ টাকা।
কলারোয়া টালিঘরের স্বত্বাধিকারি মো: আবুল হোসেন ‘বর্তমান সংবাদ’কে বলেন, আমার বর্তমানে ৩টি কারখানা রয়েছে। সেখানে নারী পুরুষ মিলিয়ে ৪৭০ জন শ্রমিক কাজ করে। প্রায় ২৫-৩০ প্রকারের টালি আমার কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে। বিশ্বের ১৩-১৪ টি দেশে এই দৃষ্টিনন্দন টালি আমরা রপ্তানি করে বৈদেশিক মূদ্রা নিয়ে আসতে পারছি। বর্তমানে এই টালি প্রধানন্ত্রীর নজর আকর্ষণ করছে।
অনেকটা অভিমানের সুরেই তিনি বলেন, আমাদের টাইলস এর খোঁজ প্রধানমন্ত্রীর রাখেন তাকে ধন্যবাদ। কিন্তু সাতক্ষীরা বিসিক বলে যে প্রতিষ্ঠান আছে তারা আমাদের কোন খোঁজ খবর নেয় না। আধুনিক প্রশিক্ষণ ও স্বল্প সুদে ঋণ পেলে আমরা আমাদের কারখানার শ্রমিক বৃদ্ধি করে আরো বেশি উৎপাদন করতে পারতাম।
কারখানার মালিক বাদল চন্দ্র পাল ‘বর্তমান সংবাদ’কে জানান, আমরা শ্রমিক নিয়োগ করে এই টাইলস উৎপাদন করলেও আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়না। সরকারের সুযোগ সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত। সরকারের সুদৃষ্টি ও সহজে রপ্তানি করার আহবান জানান তিনি।
কারখানা ম্যানেজার মিজানুর রহমান বলেন, এখানে কাজ করে বেশ ভালো আছি এখানে নারী পুরুষ সকলের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় এই টালির কদর দিনে দিনে বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
কারখানার শ্রমিক মানিক বৈদ্য বলেন, সারাদিনে আমরা ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা উপার্জন করতে পারি এতে করে আমাদের সংসার ভালো চলে। কারখানার ভিতরে ও সহজ কিছু কাজ থাকায় পরিবারের নারীরাও এখানে কাজ করার সুযোগ পায়।
স্থানীয় সাংবাদিক ফারুক রাজ বলেন, আলোচিত এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের পৃষ্টপোষকতার প্রয়োজন আছে। এই শিল্প যেমন বিদেশ থেকে ডলার উপার্জন করছে সেটি আরো বেশি অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারবে এই মাটির টালি।
নাগরিক নেতা ও কৃষি বিশেষজ্ঞ কামাল রেজা বলেন, মাটির উপরিভাগের উর্বর অংশ দিয়ে এই মাটির টালি/টাইলস তৈরি হয়। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময়ে কৃষিতে তার প্রভাব পড়বে। আধুনিক প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পিত উপায়ে এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারলে কলারোয়ার মাটির টাইলস বিশ্ববাজারে আরো বড় জায়গা করে নিতে পারবে বলে জানান তিনি।
আলোচিত এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে তাই জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের সার্বিক সহযোগীতা থাকবে পরামর্শ, প্রশিক্ষণ, এবং এই শিল্পের সাথে জড়িত পরিবারেকে স্বল্প সুদে ঋণসহ অণ্যান্য সুযোগ সুবিধার আশ্বাসের কথাও জানান তিনি।
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজলোর মুরারীকাটি, শ্রীপতিপুর, মির্জাপুর এই গ্রামগুলোতে দৃষ্টিনন্দন এই মাটির টাইলস তৈরি হচ্ছে এক যুগের বেশি সময় ধরে। প্রাচিন পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া শিল্পটি দেশে ও দেশের বাহিরে সুনাম অর্জন করেছে। সরকারের সুদৃষ্ঠি আধুনিক প্রশিক্ষন, যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি করা গেলে পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করে দেশের অর্থনীতিতে ও বেকার সমস্যার সমাধানে বড় অবদান রাখতে পারবে এই শিল্প এমনটাই প্রত্যাশা বিশেষজ্ঞদের।